গদ্য | অহনা |
---|---|
লেখক | পঙ্কজ (ছদ্ম) |
ধরণ | রম্য রচনা |
সময় | ০৭ বৈশাখ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ ১৩ এপ্রিল ২০২২ খ্রিস্টাব্দ |
বহু দিন হইলো সঙ্গনিরোধ থাকিতে থাকিতে অতিষ্ঠ হইয়া পড়িছি। কি করিবো মাথায় আসিতেছে না। হঠাৎ মনটা সূর্যোদয় দেখিবার লাগি আনচান করিয়া উঠিল। সাথে ঘটিল ঘুমের ব্যাঘাত। মনের মাঝে নব্য আশা উদিত হইতেই মাঝ রাত্রি পর আর চোখে ঘুম ধরিল না। প্রভাত পূর্বেই বেড়িয়ে পড়িলাম আশা পূর্ণ করিবার লাগি। শান্ত সলিলরাশী সামনে রাখিয়া দাঁড়াইলাম দিঘির পাড়ের একটু উঁচু জায়গায়। কোন দিকে ফিরিয়া দাড়াইলাম তা অবশ্য বলিতে হইবে না। বলিবার মতো কিছু তো নেই, তবে সূর্য উঠিতে ঢের বিলম্ব হইবে। অদ্য সূর্যি দেখিব বলিয়া এতো শীঘ্রই ঘুম থেকে উঠিয়া বাহির হইয়া আসিলাম। অন্যথা দশটার পূর্বে বিছানা ছাড়িবার মতো কর্মণ্য আমি নই,যদিও প্রাতঃকালে মহান কর্তব্য পালন করিবার হেতু সল্প সময়ের জন্য উঠিয়া থাকি।
দিঘির অপর প্রান্তে, আমার সমক্ষে পাশ্চাত্য দেখাইয়া দাঁড়াইয়া আছে আমাদেরই কলেজ খানা। এটি সামনে হইতে দেখিলে যতটা মুগ্ধ হই, পেছন হইতে দেখিলে ততটাই বিতৃষ্ণা লাগে। কলেজ যাওয়া হয় নি বহু দিন হইলো। সারা দেশে মহামারী লাগিয়া রইয়াছে।জানি না কবে হইবে সম্পন্ন এই মৃত্যুযজ্ঞের। এটা নিয়ে ত্রাসিত হইবার সময় আমার নাই। যদ্দিন বাঁচিয়া রইব, তদ্দিন আনন্দ করিয়া কাটাইয়া দিব।কুচিন্তা করিয়া সময় নষ্ট করিবার আবশ্যকতা আছে বলিয়া আমার মনে হয় না।খোদাতালা অদৃষ্টে যাহা লিখিয়া রাখিয়াছেন, তা ব্যতীত কিছুই হইবে না।
আচমকা মনে হইলো কলেজ আমাকে ব্যঙ্গ সুরে বলিতেছে,
_"আমারে দেখিতে আসিছ বুঝি? "
_"আরে না না, তোমাকে দেখিতে আসিব কি হেতু।তুমি তো সেই স্থান, যে স্থান হইতে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যহ পলায়ন করিতো।আমি কেন অকারণে বন্দিশালা দেখিতে আসিব?"
আমার এই দর্পচূর্ণকারী জবাবে কলেজের পাশ্চাত্য তিমির যেন আরও ঘোর হইয়া উঠিল।
পূর্বাকাশে রক্তিম আভা দেখা দিতেছে। হৃদয় আমার প্রফুল্ল হইয়া উঠিল, বহু কাল বাদে অদ্য আমি সেই মন-মুগ্ধকর এক দৃশ্য দেখিতে যাইতেছি। শহুরে হইয়া যাইবার পর কখনো এমন অবসর মিলেনি।কলেজের দালানের আড়াল হইতে রক্তিম বর্তুল বালার্ক তাহার মুখখানা দেখাইতে শুরু করিল। অন্ধকারাচ্ছন্ন মেদিনী আবার আলোকিত হইতে লাগিলো। অম্বরটা লাল হলুদ মিশ্রিত রঙে রাঙায়িত হইয়া উঠিল। দিনমনি কেমন যেন মৃদু হাসিয়া উঠিল, তাহার কাল্পনিক হাসি দেখিয়া মনের অজান্তেই আমার ওষ্ঠ যুগল সঞ্চালিত হইল। তপনমরীচি দিঘির সলিলে পড়িয়া কম্পিত হইতেছে। শান্ত সলিল কম্পিত হইবার হেতু হইলো, মৎসকুল ও এই মুহূর্ত উপভোগ করিবার লাগি তলদেশ হইতে উর্ধ্বে আগমন করিয়াছে।তবে তাহারা আমার সদৃশ স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া নাই, ছুটাছুটিতে অতিশয় ব্যস্ত হইয়া পড়িছে। তাহাদের আনন্দ দেখি আমার মনে পুলকানন্দের পরিমাণ দ্বিগুণ হইয়া গেল।এদিকে দিঘির কিনারায় রাখা বাঁশের কঞ্চির উপর আসিয়া বসিলো একঝাঁক বক। আর পাড়ের উপর বসিলও কিছু সংখ্যক পরভৃৎ, অন্যের ডিমে তা দেয়ার স্বভাব থাকার হেতুক তাহাদের এই নাম প্রাপ্তি হইয়াছে।নচেৎ তাহাদিককে আমরা কাক হিসেবেই চিনিয়া থাকি।কাকদের আমরা ধূর্ত ভাবিলেও প্রকৃতপক্ষে তাহারা কোন প্রকারেই ধূর্ত নয়।যাহাদের মাঝে চৌর্যের স্বভাব থাকে তাহারা কখনোই ধূর্ত হইতে পারে না,যদিও ক্ষণিকের জন্য তাহারা নিজেকে চতুর ভাবিয়া থাকে। এ নীতি কেবল উহাদের জন্য নয়,সকল প্রাণীকুলের জন্য।হঠাৎ এই দুই পক্ষীকুলের বৈপরীত্য সমূহ দৃষ্টি গোচর হইলো।এরা যে স্রেফ রূপে বিপরীত তাহা নয়।এদের স্বভাবেরও বহুত বৈপরীত্য রইয়াছে।বক শান্ত,কাক কোলাহল প্রিয়।বক খুব চতুরতার সহিত মৎস শিকার করে, কাক তা না করে তাড়াহুড়া সহিত কিছু করিবার চেষ্টা করে।বক জীবন্ত মৎস ধরিয়া খায়, কাকেদের কাছে মৃত মৎসই রুচিকর।কাকরা খাদ্য নিয়ে নিজেদের মাঝে কলহ করিয়া থাকে, বকরা তা কখনই করে না। আমাদের সমাজেও এরূপ দুপ্রকার লোকের উপস্থিতি রইয়াছে।তবে তাহাদের লেবাসের কোন তফাত নাই বলিয়া আমরা তাহাদিককে চিনিতে সর্বদা ভ্রম করিয়া থাকি।
এরই ফাঁকে আদিত্য তাহার বিক্রম প্রকাশ করিতে তৎপর হইয়া উঠিয়াছে। তাহার রক্ত রঙ মন্থরগতিতে হালকা হইতে লাগিল।পরন্তু তাহার উজ্জ্বলতা সত্বর বর্ধিত হইয়া উঠিল।ধারনা হইতেছে এ যেন হোমকুণ্ডের রক্ষিত বৃহৎ এক বৃত্তাকার কয়লা। ধপ-ধপ করিয়া জ্বলিতেছে।আমার নেত্রদয় আর তাহার পানে দৃষ্টি ফেলিতে পারিতেছে না।তথাপি বারংবার তাহার পানে দেখিতে আখিদয় বেকুল হইয়া উঠিল।বারংবার ব্যর্থ দৃষ্টি পেলিয়া মরীচি পীড়ায় পীড়িত হইয়া নেত্রদয় স্বয়ং তাহার পাপড়ি বন্দ করিতে বাধ্য হইল। তথাপি এ কেমন মোহ, যাহা কাটিয়া উঠা কষ্টকর।
অবনী হইতে সমস্ত তিমির আচমকাই চম্পট দিল।আলো-আঁধারি কাটিয়া সমস্ত ধরণী আলোয় পরিপূর্ণ।ঘাসের উপর লেপটে থাকা হিমানী কণা গুলো চিক-চিক করিতেছে। ইহাদের ও চম্পট দিবার সময় হইয়া আসিছে।
এখন তো লাগিতেছে আমাকে চম্পট দিতে হইবে। তনু আমার টলিতেছে। আমি যে বড় নিদ্রালু তাহা আর গোপন করিতে চাই না। নিশির অবশিষ্ট ঘুম এখন পরিশোধ করিতে হইবে।ফিরিতে যাইব এমন সময় পুনর্বার কলেজ পানে দৃষ্টি পড়িল। সে যেন আমার জবাবের ঝাঁজ এখনও পরিপাক করিতে পারে নাই।
_"আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি বন্দিশালা নও। ঐরকম হইলে তো আমিও সর্বদা পালাইতাম। তবে লিখাপড়া যাই হোক না কেন, তোমার আঙিনায় প্রেম আলাপ ভালোই হয়।গোলাপ গাছের গোলাপ গুলো কখনওই সম্পূর্ণ ফুটিতে পারে না, হস্তান্তরিত হইয়া যায়। হয়তো এই কারণেই মাঝেমাঝে তোমার স্মৃতি গুলো আমাকে ক্রন্দন করিতে বাধ্য করিয়া থাকে। রবীন্দ্রনাথ কেন যে তোমার বদনাম করিয়াছে, এ ব্যপারে আমি পুরোপুরি অজ্ঞ। হয়তো ফুল বাগানের কাণ্ডগুলো তাঁহার দৃষ্টি কাড়ে নাই। নতুবা তাঁহার মতো প্রেমপিপাশু কি করে তোমায় এমন তুচ্ছজ্ঞান করিল?"
এই কথা বলিয়া ডান হাতের পৃষ্ঠ দিয়া চোখ দুটি মুছিয়া লইলাম, যদিও অশ্রুপাতের কোন নামগন্ধ নাই।এত গুণকীর্তন গাইবার পরও তাহার ভাবের কোন পরিবর্তন হইলো না। হয়তো আমার এই কথা গুলিও তাহার মনকে পুলকিত করে নাই।
যাক বাবা! নিজের খেয়ে অন্যের প্রশংসা করিয়া শক্তি ব্যয় করিবার কোন আবশ্যকতা নাই। এখন একটাই লক্ষ্য, ঘুমাতে হইবে। বাসার পানে পা বাড়াইলাম,এমনি অন্তরআত্মা বলিয়া উঠিল,
_"কিরে আহমদ! তুই তো মহা নচ্ছার! এতো দিন জানিতাম তুই মেয়েদের কটাক্ষ করিতে পারছ।এখন দেখি কলেজকেই পুরা খোঁচাটা দিইয়া দিলি!"
এরকম মনো উক্তি হইতেই দুচোখ বন্দ হইল,ঠোঁটে পড়িল মৃধু কামড়।
কিন্তু একেবারেই অনিচ্ছাকৃত।